পরিবেশবাদী সংগঠন “এ্যাড ভিশন বাংলাদেশ “কতৃক আয়োজিত – –চট্টগ্রামের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের করণীয় ও নাগরিক দায়িত্ব শীর্ষক আলোচনাঃ—আজ আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস-
প্রবন্ধ উপস্থাপনঃ মো. কামাল উদ্দিন।সম্মানিত উপস্থিতি অতি আনন্দের সাথে শুভেচ্ছা সহ আমি আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন করছি – আদরণীয় সভাপতি, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী, ছাত্রছাত্রী এবং সচেতন নাগরিকবৃন্দ— আসসালামু আলাইকুম ও শুভ সকাল।
আজ ৩ জুন ২০২৫, আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি চট্টগ্রামের মতো একটি স্পর্শকাতর ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর মহানগরীর পরিবেশ রক্ষায় করণীয় ও দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করতে।
আজকের সেমিনারের মূল প্রবন্ধে প্রবেশের পূর্বে, আয়োজক সংগঠন “এ্যাড ভিশন বাংলাদেশ”-এর কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
“এ্যাড ভিশন বাংলাদেশ” শুধু একটি সংগঠনের নাম নয়—এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের নাম, একটি আদর্শিক পথচলার নাম।
গত তিন দশক ধরে এ সংগঠনটি আমাদের দেশজ পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
নদ-নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে, বায়ু ও শব্দদূষণ রোধে, বনাঞ্চল সংরক্ষণে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায়
“এ্যাড ভিশন বাংলাদেশ” সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে।
শুধু আন্দোলন-সংগ্রাম নয়, এ সংগঠনটি নিয়মিতভাবে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম, গবেষণা, প্রকাশনা, সেমিনার এবং পরিবেশবান্ধব নীতিমালার পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করে আসছে।
এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই তারা পরিবেশ রক্ষায় এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে, যা আজকের এই সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম একটি পাহাড়, নদী, সাগর ও খালনির্ভর নগরী। একসময় কর্ণফুলী নদীর জোয়ারে যেভাবে বন্দরজীবন ও নগরজীবন পরিচালিত হতো, আজ তা শুধুই স্মৃতি। কারণ কর্ণফুলী এখন দখলের করাল গ্রাসে। নদী ও খালের বুক চিরে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। জোয়ারের পানি আটকে যায় আবর্জনায়, এবং দূষিত জলাশয়ে মাছ তো দূরের কথা, জীবনও টিকে না।
আমাদের এই নগরে এমনকি রেললাইনের পাশের নালাটাও জীবন্ত নয়—তাতে মিশেছে শিল্পবর্জ্য, ট্যানারি থেকে আসা রাসায়নিক, হাসপাতালের ওষুধ আর পচা পলিথিন। কর্ণফুলীর জল কালো, দম বন্ধ করা দুর্গন্ধে মানুষ বাস করতে পারে না—এটা কোনো উন্নয়নের গল্প হতে পারে না।
আর পাহাড়? একসময় যেসব পাহাড় ছিল সবুজে আচ্ছাদিত, সেগুলো এখন রক্তাক্ত। অব্যাহত পাহাড় কাটা—কখনো ব্যক্তিমালিকানা দেখিয়ে, কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়—আজ চট্টগ্রামকে পরিণত করেছে ধ্বংসের এক প্রান্তরে। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন প্রকল্প, কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অফিস, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যক্তিগত ‘রিসোর্ট’। এইসব কর্মকাণ্ডে ভূমিধসে মারা যাচ্ছে মানুষ, শিশু; নদীতে যাচ্ছে মাটি, বৃষ্টিতে হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
চট্টগ্রামের বাতাস আজ বিষাক্ত। পোর্ট কনটেইনার টার্মিনাল, বালু-সিমেন্টের ট্রাক, জ্বালানি তেলের কালো ধোঁয়া, নিষিদ্ধ কালো ডিজেলের ট্রলার—এসবের ধোঁয়ায় নগরের শিশুরা হাঁপানি, এলার্জি, শ্বাসকষ্টে ভুগছে। স্কুলে যেতে যেতে বাচ্চারা শুনছে একটার পর একটা হাইড্রলিক হর্ণ—কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম! অথচ এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নির্বিকার, যেন দায়িত্ব নয়, কেবল পোস্টিংটাই বড় কথা।
আর গাছ? যেখানেই উন্নয়ন, সেখানেই গাছের বলি। সিটি কর্পোরেশন, সড়ক বিভাগ, রেল বিভাগ—কেউই পরিবেশবান্ধব নন। উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট চওড়া করার জন্য শতবর্ষ পুরনো গাছ কেটে ফেলা হয়, অথচ প্রতিস্থাপন হয় না।
তবে আশার কথা, এই চট্টগ্রামেই কিছু মানুষ রয়েছেন যাঁরা নির্ভীক, প্রতিবাদী। কখনো তাঁরা জেল খেয়েছেন, কখনো হুমকি পেয়েছেন, কখনো মামলা খেয়েছেন—তবু পিছপা হননি। পার্ক বাঁচাতে লড়েছেন, পাহাড় রক্ষায় মানববন্ধন করেছেন, নদী দখলকারীর বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছেন।
আমরা তাঁদের সম্মান জানাই—কারণ তারাই প্রকৃত অর্থে এই শহরের বীর। আর এই আন্দোলন যতদিন থাকবে, ততদিন চট্টগ্রাম বাঁচবে।
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই তিন কালের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মানুষের অস্তিত্ব, আর মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত তার পরিবেশ। মানুষের চারপাশে থাকা প্রকৃতি, সপ্রাণ ও অপ্রাণ জগৎ, মাটি, জল, হাওয়া, রোদ্দুর—সবকিছু মিলিয়েই তৈরি হয় পরিবেশ নামের এক জটিল ও স্পর্শকাতর পরিমণ্ডল। সাধারণভাবে আমরা যা পরিবেশ বলি, তার পরিধি সীমিত নয়—ব্যাপক অর্থে এটি বিস্তৃত স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার পেরিয়ে ওজোন স্তর পর্যন্ত, আবার নামতে নামতে পৌঁছে যায় অতলান্ত মহাসাগরের গভীরতম প্রান্তেও। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই অন্যটির সঙ্গে যুক্ত—সবই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই পারস্পরিক নির্ভরতা ও সংযুক্তির কথাই চমৎকারভাবে বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ
“এই বিশ্বে একটি আলপিনও নিরপেক্ষভাবে স্থানচ্যুত করা যায় না, সমস্ত পরিমণ্ডলে তার আপেক্ষিক প্রভাব পড়বেই।”— এই আপেক্ষিকতার সূত্র ধরেই আমাদের চারপাশে গড়ে উঠেছে অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র, বৃষ্টিচক্র, ফসফেট চক্র প্রভৃতি—যা আজ বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতেও অন্তর্ভুক্ত। মানুষের পরিবেশে আবির্ভাব মানেই জ্বালানির ব্যবহার, বসতি স্থাপন, নগরায়ণ এবং তার অনুষঙ্গে অরণ্য
সংহার, প্রাকৃতিক ভারসাম্যে ব্যাঘাত ও পরিবেশ দূষণের সূচনা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশচক্রে বিঘ্ন ঘটতে থাকে এবং তার কুফল পড়ে মানুষের স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিক পরিবেশের ওপর। এক সময় এই সমস্যা এত প্রকট হয়ে ওঠে যে, তা আর উপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না। এই প্রেক্ষাপটেই ধীরে ধীরে বিকশিত হয় পরিবেশ ভাবনা। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার ইতিহাস যদিও খুব প্রাচীন নয়, তবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে র্যাচেল কার্সনের লেখা Silent Spring নামক ঐতিহাসিক বইটি। বইটি প্রকাশের পর পরিবেশ দূষণের ভবিষ্যৎ ও তার ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে চিন্তা-চেতনার জোয়ার ওঠে।
এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র নেতৃত্বে প্রথমবার আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হয় এবং গৃহীত হয় নানান আইন ও নীতি। এরই ফলস্বরূপ প্রতিবছর ৫ই জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালিত হতে থাকে। ভারতবর্ষেও এই সময় থেকেই পরিবেশ ভাবনা ও বিজ্ঞানসম্মত চর্চার সূচনা হয়।
আজ ‘পরিবেশ’, ‘পরিবেশ ভাবনা’, ‘পরিবেশ দূষণ’ প্রভৃতি শব্দ আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। এসব এখন আন্তর্জাতিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত শব্দ। ‘বাস্তুতন্ত্র’ বা ‘ইকোলজি’ শব্দটির ব্যবহারও ক্রমে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হচ্ছে।
ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা পর্যন্ত, পরিবেশ ভাবনার পরিসর আজ অনেক ব্যাপক। পরিবেশের এই সংকট ও চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে গেলে প্রয়োজন সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা ও সর্বস্তরের অংশগ্রহণ। ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের বর্তমানেই নিতে হবে পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত। মাটি, শিলা, বনরাজি, বায়ুমণ্ডল, পাহাড়, সাগর ও মহাসাগর—এই সব নিয়েই গঠিত আমাদের প্রিয় পৃথিবী। প্রায় ৫০০ কোটি বছর আগে এর সৃষ্টি, এবং ধীরে ধীরে পরিবেশ অনুকূল হলে প্রায় ২৫০ কোটি বছর আগে মহাসাগরের গভীরে জন্ম নেয় প্রথম এককোষী জীব। সেই জীবনধারা বিবর্তনের পথে পাড়ি দিতে দিতে ৩০০ কোটি বছরের ইতিহাসে একসময় উদ্ভব হয় সরীসৃপ, তারপর পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। স্তন্যপায়ীদের মধ্য থেকেই বিবর্তনের ধারায় আসে সবচেয়ে উন্নত বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী—মানুষ।
তখন পৃথিবীর জল, স্থল, অরণ্য ও বায়ুমণ্ডলে ছিল বিচিত্র প্রাণীজগৎ। বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর গর্ভে খনিজসম্পদ, ভূগর্ভস্থ মিঠা জলের ধারা, সূর্যের অপরিমিত রশ্মি, উর্বর মাটি, বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদজগৎ এবং নদী-সাগর-মহাসাগর পরিবেষ্টিত এই পৃথিবীতে মানুষ শুধু জীবনধারণ নয়, জীবনের উৎকর্ষের প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়েছে।
খাদ্য, পানীয়, ব্যবহার্য দ্রব্য, এমনকি রোগমুক্তির উপকরণ—সবই মানুষ সংগ্রহ করেছে এই প্রকৃতি থেকেই। কিন্তু আজ, মানুষ এই প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সীমাহীনভাবে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। বায়ু, জল, মাটি ও বনসম্পদ দূষিত ও বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা সাধারণ মানুষের বোধে পৌঁছানো দরকার, যাতে তারা সচেতন হয় এবং পরিবেশ রক্ষায় সংগঠিত প্রচেষ্টার অংশীদার হয়। আমরা চাই না, মানুষসহ সকল জীবজগত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাক।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সংকট পরিবেশ দূষণ বোঝার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো—জনসংখ্যার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু সবল অর্থবল ও নানা কৌশলে একটি শ্রেণি এই সম্পদের বড় অংশ ভোগ করছে। অপরদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু প্রাকৃতিক সম্পদ কমে আসছে। কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়িয়ে ফলন ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, যার পরিণতিতে মাটি, জল ও বায়ুদূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের এই গ্রহটি সীমিত সম্পদের আধার। এটি যতটুকু খাদ্য, শক্তি এবং বর্জ্য শোষণ করতে পারে, তারও সীমা আছে। কিন্তু মানুষ তার সীমা অতিক্রম করে ফেলছে দ্রুত। বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কারণে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার প্রতিকারের সুযোগ প্রায় নেই।
বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন। কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে এই সংখ্যা বীজগাণিতিক হারে বাড়ছে। এই প্রবণতা রোধ করতে না পারলে পৃথিবীর ভারসাম্য নিশ্চিতভাবেই বিঘ্নিত হবে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, জনসংখ্যা ১২.৪ বিলিয়নের নিচে থামবে না, আর জাতিসংঘ (UNO) পূর্বাভাস দিচ্ছে, এটি ১৪ বিলিয়ন-এ গিয়ে ঠেকবে—যা বর্তমানের প্রায় তিনগুণ। অথচ আজকের এই জনসংখ্যাতেই প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে দিন কাটাচ্ছে এবং প্রতি দশজনের একজন অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত।
মানবজাতির প্রতি বিজ্ঞানীদের সতর্কতা- এই পরিবেশ সংকট মোকাবেলায় বিশ্ববিজ্ঞানী সমাজ আজ একত্র হয়েছে। গঠিত হয়েছে “উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানী সংঘ” (Union of Concerned Scientists)। তারা প্রকাশ করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল: “মানবজাতির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীদের পরিবেশগত সতর্কতা”। এই দলিলে তাঁরা মানবজাতিকে পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতন ও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
মানুষ আজ নিজের প্রয়োজনে পরিবেশ বিপন্ন করে তুলছে এবং পরোক্ষভাবে নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে হলে, আমাদের পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পরিবেশকে রক্ষা করতে না পারলে মানুষ ও সকল জীবের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
আমরা আশাবাদী—এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখা, বলা, শোনা ও জানার মধ্য দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ রক্ষায় সকলে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে আজই আমাদের সজাগ হতে হবে। চলুন আমরা চট্টগ্রামের মূল কথায় আসি -চট্টগ্রাম, আমাদের প্রাণপ্রিয় শহর। একসময় ছিল সবুজে ঘেরা পাহাড়, নদী, গাছপালা, আর মুক্ত বাতাসে ভরা এক জীবন্ত নগরী। কিন্তু আজকের চট্টগ্রাম সেই চট্টগ্রাম নয়। পাহাড় কাটা, নদী দখল, নির্বিচারে গাছ নিধন, বিষাক্ত বায়ু ও শব্দদূষণ—এসব মিলিয়ে এই শহর আজ এক ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের মুখে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সকলের—সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজ—সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই প্রবন্ধে আমরা তুলে ধরছি কিছু জরুরি করণীয়: ১. নগর পরিকল্পনায় পরিবেশ অগ্রাধিকার দিতে হবে
নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে হবে পরিবেশসম্মত। যেকোনো স্থাপনা, সড়ক, বাণিজ্যিক প্রকল্প অথবা আবাসন গড়ে তোলার আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) বাধ্যতামূলক করতে হবে। অন্ধ উন্নয়ন নয়, টেকসই উন্নয়ন চাই। নয়তো এই উন্নয়ন হবে আত্মঘাতী।
২. পাহাড় ও নদীর ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে
পাহাড় কাটা ও নদী দখলের মতো অপরাধ বন্ধে উপগ্রহ চিত্র এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। পাহাড় কাটা বা নদী দখলের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে কঠোরভাবে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে।
৩. নিষিদ্ধ হাইড্রলিক হর্ণ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে
চট্টগ্রাম শহরে শব্দদূষণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে হাইড্রলিক হর্ণ ব্যবহারে মানুষ চরমভাবে বিরক্ত ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। ট্রাফিক বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হাইড্রলিক হর্ণের ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
৪. গাছ কাটার পূর্বে প্রতিস্থাপন পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক করতে হবে-
কোনো গাছ কাটার প্রয়োজন হলে তার পূর্বেই প্রতিস্থাপন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একই জায়গায় বা শহরের অন্যত্র সমপরিমাণ গাছ রোপণ এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. নাগরিক পরিবেশ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে
স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে নাগরিক পরিবেশ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা নিয়মিত পরিবেশসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন দেবে। তারা পরিবেশ লঙ্ঘনকারীদের শনাক্ত করে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করবে।
৬. স্কুল-কলেজ পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা ও গাছ লাগানোর কর্মসূচি বাধ্যতামূলক করা
পরবর্তী প্রজন্মকে পরিবেশ সচেতন করতে শিক্ষার শুরুতেই পরিবেশ বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বছরে কমপক্ষে একটি করে গাছ লাগানো ও তা রক্ষার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। প্রতিটি স্কুল ও কলেজে নিজস্ব পরিবেশ ক্লাব থাকতে হবে।
৭. মিডিয়াকে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে
গণমাধ্যমকে পরিবেশ ইস্যুতে আরও বেশি সরব হতে হবে। শুধু দূষণের খবর নয়, পরিবেশ রক্ষার ইতিবাচক উদ্যোগ ও সাফল্যের গল্পও তুলে ধরতে হবে, যেন মানুষ অনুপ্রাণিত হয়।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্ব
* পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ও যুগোপযোগী পরিবেশ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় হতে হবে।
* পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে এবং মনিটরিং ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
* চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে শহর পরিচ্ছন্ন রাখা, সবুজায়ন বাড়ানো এবং নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।
* জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে পাহাড় ও নদী সংরক্ষণে একযোগে কাজ করতে হবে।
সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়
পরিবেশ সংরক্ষণ কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়। প্রতিটি নাগরিককেই সচেতন হতে হবে। আমরা যদি নিজেদের ঘর পরিষ্কার রাখি, শব্দদূষণ না করি, গাছ লাগাই এবং প্রতিবাদ করি—তবে একদিন এ শহর আবার তার হারানো রূপ ফিরে পাবে।
অ্যাড ভিশন বাংলাদেশ এই দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে বদ্ধপরিকর। আজকের এই সেমিনার তারই একটি বাস্তব পদক্ষেপ। চলুন, আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে শপথ করি—
গাছ বাঁচাই, পাহাড় বাঁচাই, নদী বাঁচাই—পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ, সুন্দর, বাসযোগ্য চট্টগ্রাম গড়ে তুলি।
পরিবেশ সংকট আজ কোনো কল্পকাহিনি নয়—এটি বাস্তব, প্রমাণিত এবং আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি শহরে যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা একটি বিপর্যস্ত ও শ্বাসরুদ্ধকর শহর দিয়ে যাব। তা কি আমরা চাই?
আজ প্রয়োজন শুধু বক্তৃতা নয়—প্রয়োজন কার্যকর, সুসংগঠিত ও সম্মিলিত পদক্ষেপ। প্রয়োজন প্রশাসনের আন্তরিকতা, মিডিয়ার দায়বদ্ধতা, শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা, তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ এবং প্রতিটি নাগরিকের বিবেকবান আচরণ। আমরা সবাই মিলে যদি নিজেদের অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করি—তবে পরিবেশ রক্ষা শুধু সম্ভবই নয়, নিশ্চিত।
আমরা ভুলে গেলে চলবে না—যে গাছটা আজ রক্ষা করব, সেটাই আগামী প্রজন্মের জন্য অক্সিজেন দেবে। যে পাহাড়টা আজ বাঁচাব, সেটাই আগামীর ভারসাম্য রক্ষা করবে। যে নদীটা আজ পরিষ্কার রাখব, সেটাই আগামী দিনের জীবিকা ও জীবন হয়ে উঠবে।
আজকের এই সেমিনার শুধুমাত্র একটি আলোচনার ক্ষেত্র নয়—এটি আমাদের নতুন করে ভাবার, জাগার এবং কাজ শুরু করার প্ল্যাটফর্ম। আমরা চাই, এখান থেকে যারা উঠবেন, তারা প্রত্যেকে পরিবেশের সৈনিক হয়ে ফিরবেন। প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন যেখানে অনিয়ম, সচেতনতা ছড়াবেন যেখানে অবহেলা।
আসুন, আমরা কেউই নির্লিপ্ত না থাকি। পরিবেশ রক্ষা হোক আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। আমরা যদি এখনই না জাগি, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
পরিশেষে, এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে, বিশেষ করে যাঁরা উপস্থিত হয়ে এই আলোচনাকে প্রাণবন্ত করেছেন, তাদের প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। আপনাদের এই অংশগ্রহণই প্রমাণ করে, এখনো আশার আলো আছে—এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা চট্টগ্রামকে ভালোবাসেন।
গাছ বাঁচাই, পাহাড় বাঁচাই, নদী বাঁচাই—এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিই একটি প্রাণবান, সবুজ, স্বস্তিদায়ক চট্টগ্রাম।
সবার প্রতি শুভকামনা।
শেষ কথা–এই প্রবন্ধে যদি কোথাও ভুলত্রুটি থাকে, দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।
সবাইকে আজকের সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখকঃ সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।