জামিনে মুক্ত খুনি বাবলু পুনরায় ত্রাসের রাজত্বে!

লেখক: মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

“রক্তাক্ত কর্ণফুলী: জাফরের হত্যাকাণ্ডে কাঁপছে জনপদ, জামিনে মুক্ত খুনি বাবলু পুনরায় ত্রাসের রাজত্বে — এলাকাবাসীর একটাই দাবি: গ্রেপ্তার ও ফাঁসি”

২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট, কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যার গোয়ালপাড়া এলাকায় নেমে এসেছিল এক অভিশপ্ত কালরাত। মাটির ঘ্রাণে ভরা, নদীর ধারে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর জনপদে সে রাতে শুধু একটি তরুণের মৃত্যু হয়নি—মরে গিয়েছিল আশার আলো, সাহসিকতার প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস।
নিহত তরুণের নাম জাফর। একেবারে সাধারণ পরিবারের সন্তান। বাবা ছিলেন একজন শ্রমজীবী মানুষ, মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই জাফরকে মানুষ চিনত বিনয়ী, পরিশ্রমী ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার মানুষ হিসেবে। কিন্তু কর্ণফুলীর অপরাধ সাম্রাজ্যের চোখে সে ছিল শত্রু—কেবল এজন্য যে, সে অন্যায়কে ‘না’ বলেছিল।একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড: লাইল্যার বাপের বাড়ির গলি ও অস্ত্রের ঝাঁজ সেদিন মধ্যরাতে একটি ফোন পেয়ে জাফর বাড়ি থেকে বের হয়। তাকে ডেকে নেওয়া হয় কর্ণফুলী থানার গোয়ালপাড়ার ‘লাইল্যার বাপের বাড়ি’র পাশের গলিতে। সেখানেই ওঁত পেতে থাকা একদল সশস্ত্র যুবক তাকে ঘিরে ফেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হামলাকারীদের নেতৃত্বে ছিল ভয়ঙ্কর কুখ্যাত ইয়াবা ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারী ইমরান হোসেন বাবলু। তার সঙ্গে ছিল আরও ১০-১২ জন সন্ত্রাসী। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় বর্বর আক্রমণ—চাপাতি, রড, হকিস্টিক, লাঠি দিয়ে জাফরের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। জাফর প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসার সাহস করেনি। কারণ, কর্ণফুলীর মানুষ জানে—বাবলু মানেই মৃত্যু, প্রতিবাদ মানেই শাস্তি।
অপরাধ-সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন: বাবলুর পরিবার ও চক্রের উত্থান ইমরান হোসেন বাবলু—এই নামটি আজ কর্ণফুলীর শিশুরাও জানে। তার পিতা রেজাউল করিম ছিলেন একসময়কার কুখ্যাত ডাকাত সর্দার। মা সাজেদা এলাকাবাসীর কাছে ‘ইয়াবা সম্রাজ্ঞী’ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, সাজেদা একসময় পতিতাবৃত্তি ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তাদের ঘরে বেড়ে ওঠা বাবলু খুব অল্প বয়সেই হয়ে ওঠে এলাকার ‘ডন’।
জানাজানি আছে, ইয়াবা, নারী পাচার, দেহব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা ও চাঁদাবাজি—সবকিছুতে তার শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এই অপরাধ জাল। জাফরের জিডি, পুলিশের নিরবতা: প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় খুনের লাইসেন্স? জাফরের পরিবার জানায়, মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগেই জাফর কর্ণফুলী থানায় গিয়ে একাধিকবার জিডি করেছিলেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তার জীবনের ওপর হুমকি রয়েছে, এবং বাবলু চক্র তাকে মারার জন্য পেছনে লেগেছে।
থানার রেকর্ডেও সেই জিডিগুলোর অস্তিত্ব আছে। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। প্রশ্ন উঠে—কেন? একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “বাবলু চক্র থানা ও রাজনীতির কিছু শক্তিধর ব্যক্তির ছত্রছায়ায় ছিল বলেই পুলিশ তখন নিরব থেকেছে। পুলিশ চাইলে এ হত্যা ঠেকানো যেত।” ঘটনার পর — থানা ঘেরাও, প্রতিবাদ আর আশাহত জনতা জাফরের নির্মম হত্যার পর কর্ণফুলী থানার সামনে জড়ো হয় শত শত মানুষ। গর্জে ওঠে জনতা— “জাফরের খুনি বাবলুর ফাঁসি চাই!” “ইয়াবা দেহব্যবসার নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দাও!”
প্রতিটি গলিতে গলিতে পোস্টার— “খুনি বাবলু ও তার মা সাজেদার ফাঁসি চাই – কর্ণফুলী থানাবাসী।” সেই বিক্ষোভ শুধু একজন তরুণের মৃত্যু নয়, বরং একটি সমাজের দীর্ঘদিনের ঘুম ভাঙার ইঙ্গিত ছিল। আরেকটি মৃত্যু—দেলোয়ার হোসেন: এক পিতার জীবন গেল ছেলের গেম খেলার কারণে!
২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট, একই রাতে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। মো. নয়ন নামে এক কিশোর স্থানীয় একটি জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে কাজ করত। মোবাইল গেম নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় বাবলুর সহযোগী ‘আবার’-এর সঙ্গে। সন্ধ্যায় নয়নকে আটকিয়ে রাখে একদল যুবক। খবর পেয়ে ছেলেকে বাঁচাতে আসেন বাবা দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু সেখানেই শুরু হয় নির্মম পিটুনি। ক্রিকেট স্টাম্প, লাঠি, হকিস্টিক দিয়ে পেটানো হয় দেলোয়ারকে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। থানায় দায়ের হয় মামলা নং ৩৭/২৫.৮.২০১৭। আসামিদের মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বরকে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা হলেও মূল আসামি বাবলু থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। জামিনে মুক্ত বাবলু — আবারও প্রকাশ্যে ত্রাস সৃষ্টিতে ব্যস্ত
এত বড় অপরাধের পরও ইমরান হোসেন বাবলু আজ জামিনে মুক্ত। অভিযোগ, জামিনের পর সে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। গত ৮ জুন সে আবারও নিহত জাফরের বাড়ির সামনে গিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখিয়েছে। তার সঙ্গে ছিল সশস্ত্র দল, যারা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাবলুর পেছনে রয়েছে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদ-এর রাজনৈতিক আশ্রয়। জনগণের ভাষা, দাবির বজ্রনিনাদ: “আর কোনো জাফর যেন না মরে!”
একজন বৃদ্ধ মসজিদ ইমাম কাঁদতে কাঁদতে বলেন: “জাফর শুধু প্রতিবাদ করেছিল, আর তাই তাকে মেরে ফেলা হলো। এখন তার পরিবার আতঙ্কে দিন কাটায়। এ কেমন দেশ, যেখানে সত্য বললে মরতে হয়?” একজন নারী বলেন: “আমার ছেলেটাও প্রতিবাদ করে। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না—জাফরের মতো ওকে ওরা মেরে ফেলবে না তো?” উপসংহার: এই প্রতিবেদন একটি প্রশ্ন রাখে—এক জাফর মরলো, আমরা কি পরবর্তী জাফরকে বাঁচাতে পারবো?
জাফরের মৃত্যু শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়—এটি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ব্যর্থতা, প্রশাসনের দুর্নীতি, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গজিয়ে ওঠা অপরাধ সাম্রাজ্যের চরম প্রতিচ্ছবি। যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে বাবলুদের হাতে মরবে আরও অনেক জাফর, আরও অনেক দেলোয়ার।
আমরা কি চুপ থাকব? নাকি সোচ্চার হব? এই দেশ, এই সমাজ, এই প্রশাসন—জাফরের রক্তের কাছে দায়ী। সেই দায় এখনই শোধ করার সময়।
“আসুন, আমরা সকলের সম্মিলিত আওয়াজে জাফর হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করি। বাবলুর মতো খুনিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই—এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই দেশকে রক্ষা করতে।”

  • জামিনে মুক্ত খুনি বাবলু পুনরায় ত্রাসের রাজত্বে!