একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর, আর একটি আগুন : শেখ হাসিনার পতনের নেপথ্য সাংবাদিক”
একটি প্রশ্ন কখনো কখনো ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যখন সেই প্রশ্ন আসে রাষ্ট্রক্ষমতার সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় বসা ব্যক্তির মুখোমুখি এক সংবাদ সম্মেলনে। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই, চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আসীন, তখন একটি প্রশ্ন ঝড় তুলে দেয় দেশের ছাত্রসমাজ ও জাতীয় বিবেকের মাঝে। প্রশ্নটি ছিল— “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি‑পাতিরা যদি কোটা না পায়, তাহলে কি রাজাকারের নাতি‑পাতিরা পাবে?” প্রশ্ন করেছিলেন যেই- সাংবাদিক” তিনি হলেন “প্রভাষ আমীন, সেই একজন পরিচিত ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক, যিনি বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যম ATN News-এ সিনিয়র সাংবাদিক ও শিরোনাম প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুতে স্পষ্ট প্রশ্নোত্তর এবং সংবাদ সম্মেলনে সরব অংশগ্রহণের জন্য তিনি পরিচিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর শেষে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একটি প্রশ্ন করেন, যা দেশে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। তার প্রশ্ন ছিল— “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি‑পাতিরা যদি কোটা না পায়, তাহলে কি রাজাকারের নাতি‑পাতিরা পাবে?”
এই প্রশ্নটি তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তরুণ সমাজে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। এর জের ধরেই ১৫ ও ১৬ জুলাই ঢাবি এবং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। “তুমি কে, আমি কে—রাজাকার, রাজাকার” স্লোগানে গর্জে ওঠে ক্যাম্পাস। এই ঘটনাটি রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত জাতীয় পরিচয়বোধের প্রশ্নে নতুন করে আলোড়ন তোলে এবং একটি সাংবাদিক প্রশ্ন কিভাবে একটি গণআন্দোলনের সূচনা ঘটাতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ হয়ে ওঠে। রাজনীতির মঞ্চে কখনো কখনো একটি মাত্র প্রশ্নই হয়ে ওঠে ইতিহাস বদলে দেওয়ার কারণ। একটি সংলাপ, একটি ভুল অভিব্যক্তি—এইসবই তৈরি করে এমন ঝড়, যা ক্ষমতার অট্টালিকা কাঁপিয়ে তোলে। সেইরকমই এক মুহূর্ত রচিত হয়েছিল সেই সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্য চীন সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। ১৪ই জুলাই ২০২৪ইং তারিখে বিকাল ৪টায় গণভবনে-পরম্পরাগতভাবে আয়োজিত সেই সংবাদ সম্মেলনে তিনি অংশ নেন তাঁর মনোনীত প্রিয় সাংবাদিকদের নিয়ে—যাঁরা মূলত গঠনমূলক সমালোচনার চেয়ে প্রশংসা ও তোষামোদে পারদর্শী।
সে সময় সারা দেশে চলছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা স্বোচ্চারে বলছিল—“মেধার মান দাও, কোটা নয়।” এই দাবির পেছনে ছিল একটি বাস্তবতাভিত্তিক যুক্তি—যেখানে সরকারি চাকরিতে ৫৫% কোটা পদ্ধতিতে সংরক্ষিত থাকায় প্রকৃত মেধাবীদের অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছিল।এমন উত্তাল পরিস্থিতির মাঝেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চিরাচরিত ঢংয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। কথার ছলে হঠাৎ তিনি এমন একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন, যা উপস্থিত সবাইকে হতবাক করে দিলো—“আমার গণভবনের পিয়ন এখন ৪ কোটি টাকার মালিক! সে হেলিকপ্টারে বাড়ি যায়।”
এ কথা হাস্যরস হিসেবে বলা হলেও, তখনকার উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে এটি জনগণের কাছে ছিল ধৃষ্টতা ও বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন এক কল্পকথা। প্রধানমন্ত্রী যেখানে মেধাবীদের দাবির প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার কথা, সেখানে এমন বক্তব্য যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো।
এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সরকারের তোষামোদকারী পরিচিত এক সাংবাদিক, যিনি বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা ও সমর্থন জুগিয়ে থাকেন। সেই মুহূর্তে তিনিই উসকে দিলেন সেই “ঐতিহাসিক প্রশ্ন” যা পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে নতুন স্লোগানের জন্ম দেয়, ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে।সাংবাদিকটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন—“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিবিএস পরীক্ষায় যদি দু’জন সমান নম্বর পায়—একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আরেকজন রাজাকারের সন্তান—আপনি কাকে নিয়োগ দেবেন?”প্রশ্নটি ছিল-“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পাতিরা যদি কোটা না পায় তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পাতিরা পাবে?”
বিষয়টি ব্যাপক বিতর্ক উস্কে দেয় এবং শিক্ষার্থীদের “তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার” স্লোগান, আন্দোলন শুরু হয় প্রশ্নটি শুনে প্রথমেই যে ভাবনা আসে, তা হলো—এটি আদৌ সময়োপযোগী ও যথার্থ প্রশ্ন কি না। কারণ কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রশ্নই ছিল মেধাবী বনাম কোটাধারী—এখানে কোনোভাবেই রাজাকার-পক্ষ বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো বিভাজনের প্রসঙ্গ ছিল না। এই প্রশ্ন আন্দোলনকে প্রকৃত রূপরেখা থেকে সরিয়ে, এক ভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্কে নিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি কৌশলী হতেন, তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সরাসরি বললেন—আমি মুক্তি যোদ্ধার সন্তানকে না নিয়ে- রাজাকারের সন্তানকে নেব?” এই উত্তর ছিল আত্মঘাতী। কারণ তিনি সরাসরি ওই প্রশ্নে উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে রাজাকারের সন্তানকে চিহ্নিত করলেন। মেধাবীদের, যারা কেবলই ন্যায্যতার জন্য আন্দোলন করছিল, হঠাৎ করেই তারা ‘রাজাকারের সন্তান’ হিসেবে প্রাধান্যমন্ত্রীর চোখে প্রতিস্থাপিত হলো।
এর প্রতিক্রিয়া ছিল ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা জনস্রোত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শুরু করে হলগুলোর প্রত্যেক চত্বরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভয়ংকর স্লোগান: “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার!”
এই একটি বাক্য রাতারাতি স্লোগানে রূপ নেয়। সারারাত টানা প্রতিবাদ চলে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে তৈরি হয় অপমান আর ক্ষোভের গভীর ক্ষরণ। তাদের প্রিয় দেশ, তাদের অধিকার চাওয়ার প্রতিদান হিসেবে তারা পেল ‘রাজাকারের’ অপবাদ! এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী যদি একটু সংবেদনশীল হতেন, তিনি বলতে পারতেন—”মেধার ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়া উচিত, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রতি আমাদের সম্মান ও সহানুভূতি থাকবেই।”
কিন্তু না, সেই রাজনৈতিক কৌশল ও ভারসাম্যের পরিবর্তে তিনি বেছে নিলেন সরাসরি প্রতিক্রিয়া। এর পেছনে দায় ছিল প্রশ্নকারী সাংবাদিকের, যিনি ভুল সময়ে ভুল প্রশ্নটি উত্থাপন করে নিজে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর বাহবা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু রাজনীতি এত সরল নয়। যাঁদের ঘর পুড়লে আলো পড়ে, তাঁরা সব দেখতে পারেন। সেই আলোয় স্পষ্ট হয়ে গেল এই সাংবাদিকের তেলবাজি মূলত মেধাবী ছাত্রদের দাবিকে কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করেছে, প্রধানমন্ত্রীর সামনে একটি বিকৃত প্রশ্ন এনে দিয়েছে।
এই একটি ভুল প্রশ্ন আর একটি অবিচারপূর্ণ উত্তর হয়ে উঠলো শেখ হাসিনা সরকারের জন্য রাজনৈতিক আত্মঘাতী ধাক্কা। এ ঘটনার পর আন্দোলন এমন উচ্চতায় পৌঁছায় যে, সরকার ব্যাকফুটে চলে যায়। জনগণের চাপ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, প্রশাসনিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্তহীনতা, এবং শেষ পর্যন্ত সেই শাসনব্যবস্থা হিমশীতল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি একসময় ছিলেন রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রতীক, সেই তিনিই একপর্যায়ে গণদাবির চাপে দেশত্যাগে বাধ্য হন।একটি সংবাদ সম্মেলন, একটি ভুল প্রশ্ন, একটি উত্তপ্ত উত্তর—এই তিনটি উপাদান তৈরি করে দিলো ইতিহাসের এক বাঁকবদল।এই ঘটনাটি আমাদের শিক্ষা দেয়—✦ সাংবাদিকতা কেবল প্রশ্ন করা নয়, সেটি যথাসময়ে, যথার্থভাবে করতে জানতে হয়।✦ রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের উচিত উত্তরে দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা।✦ তোষামোদী সাংবাদিকতা কখনো রাষ্ট্রের পক্ষে যায় না—শেষ পর্যন্ত তা গণবিরোধিতার কারণ হয়ে ওঠে।আজ সেই সাংবাদিক হয়তো ভুলে গেছেন তার করা সেই এক প্রশ্নের পরিণাম, কিন্তু ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে। আর শেখ হাসিনার পতনের পেছনে অনেক ভুল সিদ্ধান্তের পাশাপাশি এই ভুল প্রশ্ন এবং অবিবেচক উত্তরটিও বড় কারণ হিসেবে থেকে গেছে।
প্রশ্ন উঠবেই—যদি প্রশ্নটি হতো:“মেধা বনাম কোটা—আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?”তাহলে হয়তো উত্তরও হতো যুক্তিপূর্ণ, সহানুভূতিসম্পন্ন।হতো না রাজাকার বনাম মুক্তিযোদ্ধার বিভাজন।জ্বলত না দেশ।জ্বলত না ছাত্রদের আত্মমর্যাদার বেদনায় এক যুগান্তকারী আন্দোলন।