বাঁশখালীর আলোকবর্তিকা নজির আহমদ মাস্টার: এক সূর্যসন্তানের শ্রদ্ধার্ঘ্য”
আমি আজ বিনম্র শ্রদ্ধা আর গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি বাঁশখালীর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, শিক্ষার বাতিঘর,
দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রিয় শিক্ষক মরহুম নজির আহমদ মাস্টারকে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমি নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করি, আবার এই আলোচনায় অংশ নিতে পেরে গর্ববোধ করি। তিনি ছিলেন শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি ছিলেন এক মানবপ্রেমিক, সমাজসংস্কারক ও সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। নজির আহমদ মাস্টারের জীবনের আলোয় আলোকিত হয়েছে বহু অন্ধকার। কিন্তু তাঁর আলোয় আলো হওয়া এই গল্প শুরুর আগে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে তাঁর জন্মভূমি বাঁশখালীর দিকে—এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ, যেখানে পাহাড় ও সমুদ্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে সহাবস্থানের প্রতীক হয়ে।
বাঁশখালী শুধু একটি উপজেলা নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, দুর্যোগ আর সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। একদিকে কর্ণফুলীর শাখা নদী আর বঙ্গোপসাগরের বিশাল বুকে জেগে থাকা জনপদ, অন্যদিকে লোহিত পাহাড়ের রক্তমাখা পাদদেশে গড়ে ওঠা মানবসমাজ। প্রকৃতির রূঢ় আচরণ বারবার এই জনপদকে ভেঙেছে, কেঁপে উঠেছে মানুষ। কিন্তু তবুও বাঁশখালীর মানুষ হার মানেনি—যেমন হার মানেননি নজির আহমদ মাস্টার।
এই জনপদের বুকে জন্মেছিলেন বহু কীর্তিমান। ইতিহাসবিদ প্রফেসর আবদুল করিম, অধ্যাপক আসাহাব উদ্দিন থেকে শুরু করে অসংখ্য আলোকিত শিক্ষক-প্রতিভা—যাঁরা শুধু বাঁশখালী নয়, আলোকিত করেছেন সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল। তাঁদের সংখ্যাও কম নয়—চার শতাধিক শিক্ষক তাঁদের জ্ঞানের আলো বিলিয়েছেন সময়কে ছাপিয়ে।
তবে নজির আহমদ মাস্টার ছিলেন আলাদাভাবে উজ্জ্বল। তিনি শুধু পাঠ্যবইয়ের শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন নৈতিকতার শিক্ষক। দুর্যোগে তিনি দান করেছেন সাহস, দুর্ভিক্ষে দিয়েছেন আশ্রয়, হতাশায় জুগিয়েছেন প্রেরণা। মানুষকে শুধু শিক্ষিত নয়, করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী। তাঁকে স্মরণ করা মানে সময়ের সঙ্গে এক মহৎ মানবিকতার সেতুবন্ধ তৈরি করা।
বাঁশখালী বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী—১৭৯৫, ১৮৭৬, ১৮৯৭, ১৯৬০ ও ১৯৯১ সালের পাঁচটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ জনপদ ক্ষতবিক্ষত হলেও, তার বুকচেরা কান্নার মধ্যে থেকেও উঠে এসেছেন এমন কিছু মানুষ, যাঁরা ছিলেন আলোর বাহক। তাঁদের মধ্যে নজির আহমদ মাস্টার ছিলেন এক দীপ্ত প্রদীপ, যিনি নিজের আলোয় অন্যকে পথ দেখিয়েছেন।
১৯৫৮ সালে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হলেও, বাঁশখালীর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সমুদ্র আর পাহাড়ের বন্ধনে বেড়ে ওঠা এ জনপদে একসময় জনপথ ছিল জলপথ, সহজ ছিল না চলাচল। কিন্তু তবু মানুষ এসেছে, গড়েছে ঘর, আর এই জনপদের মানুষই দিয়েছে নজির আহমদের মতো আত্মত্যাগী, নিষ্কলুষ পথপ্রদর্শক।
আজকের এই স্মরণ সভায় যখন আমরা তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি, তখন মনে হয়—একটি প্রদীপ নেভে না, তার আলো অন্যদের হাতে পৌঁছে যায়। নজির আহমদ মাস্টারের আলোও পৌঁছে গেছে তাঁর ছাত্রদের হৃদয়ে, তাদের জীবনে। আমরা সেই আলো বহন করছি, করব, এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছেও তা পৌঁছে দেব।
আমরা তাঁকে হারাইনি, তিনি ছড়িয়ে আছেন আমাদের চিন্তায়, আমাদের শিক্ষা-দর্শনে, আমাদের মূল্যবোধে।