সাংবাদিকতার বাতিঘর: জহুর হোসেন চৌধুরী — জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে এক স্মরণীয় পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ ২৭ জুন—বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভের জন্মদিন। আজ জহুর হোসেন চৌধুরীর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। স্মরণ করি এক অকুতোভয়, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংবাদিক-সম্পাদককে, যিনি শুধু সংবাদপত্র পরিচালনাই করেননি, বরং একটি জাতির রাজনৈতিক চেতনাকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
জন্ম ও শিক্ষা: এক প্রতিভার বিকাশ-জহুর হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯২২ সালের ২৭ জুন, ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার রামনগর গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মস্থল সিরাজগঞ্জ। ছোটবেলায় পারিবারিক পরিবেশেই পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় তাঁর। তারপর পাঠশালা, প্রাইমারী এবং সিরাজগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সি কলেজে, কলকাতায়। সেখান থেকে ১৯৪০ সালে আইএ এবং ১৯৪২ সালে ইতিহাসে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। স্বাস্থ্যগত কারণে এমএ শেষ করা সম্ভব না হলেও, জ্ঞানের তৃষ্ণা থেমে থাকেনি।
সাংবাদিকতায় প্রবেশ: কলমকে বানালেন অস্ত্র-জহুর হোসেন চৌধুরীর সাংবাদিকতা শুরু হয় হাবীবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায়। পরে তিনি কলকাতার খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’, ‘কমরেড’ ও ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’-তে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ফিরে আসেন পূর্ববাংলায়। কিছুদিন সরকারি চাকরিতে কাটিয়ে তিনি আবার ফিরে যান সাংবাদিকতার টানে—এ যেন আত্মার টান। ১৯৫১ সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদ-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে। আর ১৯৫৪ সালে হন সম্পাদকের আসনে। এরপর থেকে তার জীবন ও সংবাদ—দুইটি হয়ে ওঠে অভিন্ন সত্তা। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, নিপীড়ন—সব উপেক্ষা করে সংবাদ হয়ে ওঠে প্রগতিশীল চিন্তার আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদ যেভাবে খবর ছেপেছে, দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তা ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়। হানাদার বাহিনী একে ভয় পেয়ে সংবাদ কার্যালয় আগুনে পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি সম্পাদনা করেন ইংরেজি সাময়িকী Counter Point, আর আজীবন ছিলেন সংবাদ-এর অন্যতম পরিচালক।
রাজনীতি ও সংগঠকতা: কলমের পাশে কণ্ঠ-জহুর হোসেন কেবল সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদও। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হন। চীন-পাকিস্তান ও সোভিয়েত-পাকিস্তান মৈত্রী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের একত্রীকরণে ব্যাকস্টেজ নায়ক, আইয়ুব বিরোধী ঐক্য গঠনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আজকের জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি সম্মেলন কক্ষ তাঁর নামেই—“জহুর হোসেন চৌধুরী হল”—যা তাঁর অবদানেরই স্বীকৃতি।
সাহিত্যিক ও কলাম লেখক: দরবার-ই-জহুর-দৈনিক সংবাদের পাতায় তিনি লিখতেন জনপ্রিয় রাজনৈতিক কলাম “দরবার-ই-জহুর” শিরোনামে, যা সময়ের সাহসী প্রতিচ্ছবি। ১৯৮৫ সালে তাঁর এই লেখাগুলোর সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়, নাম “দরবার-ই-জহুর”। তার আরও উল্লেখযোগ্য বই হলো: Shaping the Press in Pakistan Quest for Freedom: Writings of a Journalist
দুটি বই বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সংরক্ষিত রয়েছে-
মূল্যায়নের অভাব ও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে আমার দীর্ঘ গবেষণার সময়, বিশেষ করে আমার লেখা ‘সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কথা’ গ্রন্থে আমি যেসব পথিকৃতের জীবনের খোঁজ করেছি, তাদের মধ্যে জহুর হোসেন চৌধুরী অন্যতম। তাঁর সাহসিকতা, স্পষ্টভাষী ভূমিকা, এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আজও অনুকরণীয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁর নাম ও অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি।
এমন একজন দূরদর্শী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে শুধু প্রেসক্লাবের একটি হলে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর জীবনী ও লেখাকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে নতুন প্রজন্ম সাংবাদিকতার মূল আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারে—সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়, এটা সমাজ রূপান্তরের এক ঐতিহাসিক হাতিয়ারও হতে পারে, যদি তাতে জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো মানুষের চেতনা মিশে থাকে।
শেষ শ্রদ্ধা-১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে, জহুর হোসেন চৌধুরী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তবে রেখে গেছেন এমন একটি আদর্শ, যেটি এখনও আমাদের পথ দেখায়। ১৯৮১ সালে মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিকের স্মরণে দৈনিক সংবাদ চালু করেছে ‘জহুর হোসেন স্মৃতিপদক’, যা নবীন সাংবাদিকদের প্রেরণার উৎস।
আজ, তাঁর জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে ১০৪তম জন্মদিনে আমরা শুধু স্মরণ করি না, অঙ্গীকার করি—সাংবাদিকতা যেন সত্য, ন্যায়, মানবিকতা ও প্রগতির পাশে থাকে। জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো মানুষেরাই আমাদের শেখান কীভাবে কলম হতে পারে একটি জাতির চেতনার ধারক ও বাহক।
শ্রদ্ধা জহুর হোসেন চৌধুরী।
আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন—বাংলাদেশের সাংবাদিকতার গর্ব হয়ে।
লেখক সাংবাদি, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক-