অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার চিন্তা-মননের আলোকধারা ও মানবিক বোধের পাঠ

লেখক: মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ৩ দিন আগে

“চেতনার সংকট”: অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার চিন্তা-মননের আলোকধারা ও মানবিক বোধের পাঠ”

নিস্তব্ধ দুপুরে শব্দেরা যখন অলস ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে থাকে, তখন হঠাৎই এক কলমে শব্দেরা জেগে ওঠে। শব্দেরা নড়ে চড়ে বসে—কারও গম্ভীর চিন্তার ভারে, কারও আবেগের আলোড়নে। আর যখন সেই কলমটি হয় অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার মতো একজন ভাবুক, মানবিক ও সত্যনিষ্ঠ লেখকের, তখন সেই শব্দগুলো আর শব্দ থাকে না—তারা হয়ে ওঠে মনের আয়না, সময়ের প্রতিচ্ছবি, এবং সমাজের নিরাবরণ সত্য।


তিনি লেখেন, যেন নদী বয়ে চলে। শব্দের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে দেন চেতনার ঢেউ। কখনো তা কোমল, কখনো তা প্রশ্নবিদ্ধ; কিন্তু সবসময় তা সৎ ও অনুভবের গাঢ়তায় ভরপুর। তাঁর কলমে আছে গ্রামের সরলতা, শহরের জটিলতা, সমাজের চিত্রপট, এবং আত্মার দুর্বোধ্য ক্যানভাস।কেউ যখন বলেন “চেতনার সংকট”, অনেকে ভাবে এটুকু বুঝি বাণী মাত্র। কিন্তু জিতেন্দ্র বড়ুয়ার লেখায় এ সংকট নয় কেবল অভিযোগের দলিল, বরং এক আত্মদর্শনের হাতছানি। তিনি কলম ধরেন, যুদ্ধ করতে নয়, আলো ছড়াতে। তিনি প্রবন্ধ লেখেন, বক্তৃতা দিতে নয়, মানুষ গড়তে। একজন লেখক হিসেবে তাঁকে পাঠ করা মানে, নিজের ভেতরের আয়নায় তাকানো। আর একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি বলবো—এমন লেখকদের পাশে থাকা মানেই সত্যের পাশে দাঁড়ানো। তাঁর কলমে সমাজ যেন নিজের মুখ দেখে। আর আমি, এই পাঠক, মুগ্ধ হয়ে শুধু বলি—”আপনি লিখুন, জিতেন্দ্র দা, আমরা পাঠ করবো হৃদয়ের শ্রদ্ধায়, বিবেকের মুগ্ধতায়।” সময়ের এক নিঃশব্দ ভাষ্যকার, সমাজসচেতন একজন নিবেদিত শিক্ষক, একজন সত্যনিষ্ঠ কবি ও প্রাবন্ধিক—অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া যেন আমাদের সময়ের এক সজ্জন প্রহরী, যিনি জীবনের সূক্ষ্মতম অনুভূতি ও মানবিক চেতনার ভেতর থেকে তুলে আনেন সমাজ ও সভ্যতার অন্তঃসলিলা সংকেত। তাঁর সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ “চেতনার সংকট” কেবল একটি গ্রন্থ নয়, এটি এক দার্শনিক আত্মজিজ্ঞাসার দলিল।
গ্রন্থটি পাঠ করতে করতে মনে হয়—এ যেন আমাদের চারপাশে পুঞ্জীভূত অন্ধত্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিশুদের করুণ বাস্তবতা, ধর্মের মোড়কে বিকৃত প্রভাব, পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা ও শিক্ষা ব্যবস্থার শিথিলতার বিরুদ্ধে এক সুনির্বাচিত কলমযুদ্ধ। প্রথমেই বলতে হয়, অধ্যাপক বড়ুয়ার জন্মস্থানের প্রতি মমত্ববোধ তাঁর লেখার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। “জলদী আমার গ্রাম” প্রবন্ধে তিনি যে ভাষায় স্মৃতিমাখা গ্রামীণ জীবনকে তুলে ধরেছেন তা যেন প্রকৃতির নিজস্ব কাব্যিকতা। তিনি লিখেছেন: “এই জলদীর প্রতিটি ঢেউয়ে, প্রতিটি শিশিরফোঁটায়, আমার শৈশবের আলো ও কান্না মিশে আছে।” এই প্রবন্ধে আমরা একটি সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের হৃদয়ের টান অনুভব করি। তাঁর এই অনুভব কেবল স্থানিক নয়, তা বিস্তৃত হয়েছে বৃহত্তর মানবসমাজ পর্যন্ত। তাঁর কলম যখন স্পর্শ করে শিশুশ্রম, তখন তা একধরনের আকুতি হয়ে ওঠে; যেমন তিনি লেখেন— “ছোট ছোট হাতগুলো যখন কালি-কলমের বদলে পাথরের টুকরো ধরে, তখন সভ্যতার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করি—এতটুকু দায়িত্ব কি আমাদের নয়?”
অধ্যাপক বড়ুয়ার লেখায় চেতনার সংকট মানে কেবল সমাজের অসঙ্গতি নয়, এটি আত্মজিজ্ঞাসারও সংকট। মানুষের ভেতরের বিবেক যখন নিশ্চুপ হয়ে যায়, তখনই এই চেতনার সংকট ঘনীভূত হয়। তাঁর প্রবন্ধ ‘মূল্যবোধ, সুশিক্ষা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ যেন আমাদের বর্তমান বাস্তবতাকে খণ্ড খণ্ড আয়নায় প্রতিফলিত করে। তিনি শুধু বিশ্লেষণ করেন না, বরং নির্দেশও দেন। তাঁর কলমে আছে অভিজ্ঞতার ভার, শিক্ষকসত্তার গভীরতা এবং মানবিক বোধের কোমলতা।
“পরিশুদ্ধ মানুষ মাত্রেই প্রিয় মানুষ”—এই বাক্য যেন তাঁর চিন্তার মূলমন্ত্র।যেমন ধর্ম নিয়ে তিনি বলেন—
“ধর্ম মানুষকে বিভাজন নয়, সংযোগ শেখায়। প্রকৃত বৌদ্ধ হবার মানে ধর্মের মূল অনুশাসন আত্মস্থ করা। শাসন নয়, সহানুভূতির চর্চাই ধর্মের সত্যরূপ।” এই গ্রন্থে রয়েছে পিতা-মাতার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা, শিক্ষাগুরুর প্রতি সম্মান, ধর্মগুরুদের জন্য শ্রদ্ধা। তাঁর লেখনী যেন কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ নয়—তা হৃদয়ের প্রশস্ত পরিধিতে প্রশ্রয় পায়, বিবেকের বাতিঘর হয়ে আলো ছড়ায়। বিশেষ করে, ‘মৃত্যুর আগে কর্মের স্বীকৃতি হোক’ প্রবন্ধে কবি এক অন্তর্মুখী আত্মকথনের মাধ্যমে জীবনের পরম সত্যকে ছুঁয়ে যান।
“জীবনের অন্তিমে সম্মান নয়, কর্মে সার্থকতা—এই হোক আমাদের জীবনের পাঠ।”চেতনার সংকট তাই কেবল সামাজিক বিশ্লেষণ নয়; এটি নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধনের প্রয়োজনীয়তা, শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার নির্দেশনা এবং একটি শুদ্ধ সমাজ গঠনের নির্মোহ ভাষ্য। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় রয়েছে উপলব্ধির স্নিগ্ধতা, জীবনদর্শনের প্রতিফলন এবং সত্যের নির্ভীক উচ্চারণ। এই গ্রন্থ অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার একটি নির্যাসসম কণ্ঠস্বর—যেখানে আছে তপস্যা, আছে ভাবনা, আছে দৃষ্টিভঙ্গির ঋদ্ধতা। “চেতনার সংকট” একটি সময়োপযোগী, পাঠযোগ্য এবং সমাজমনস্ক গ্রন্থ, যা আজকের ক্লান্ত, বিপথগামী সমাজে এক প্রজ্ঞার বাতিঘর হয়ে উঠতে পারে। এটি কেবল একজন কবি বা শিক্ষকের লেখা নয়, এটি একজন মানবিক চিন্তাবিদের আত্মার আত্মপ্রকাশ।অধ্যাপক জিতেন্দ্র বড়ুয়া আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। তার আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গি, সরলতা আর হৃদয়ের আন্তরিকতা আমাকে সবসময় আকৃষ্ট করেছে। তিনি একজন শিক্ষক, চিন্তাবিদ, লেখক ও প্রাবন্ধিক হলেও তার মধ্যে কোনো অহংকার নেই—বরং তিনি এক নিবেদিত প্রাণ জ্ঞানসাধক, যিনি মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ জাগাতে চান লেখার মধ্য দিয়ে। আমি তো একজন সাধারণ মানুষ, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে পথ চলা। আমার না আছে কোনো উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট, না আছে জ্ঞানগর্ভ ভাষা বা তত্ত্ব-কথার অধিকার। তাই যখন অধ্যাপক জিতেন্দ্র বড়ুয়া নিজে আমাকে বললেন, তাঁর নতুন বই “চেতনা সংকট” নিয়ে যেন আমি কিছু লিখি, তখন আমি অবাক হয়ে গেলাম, অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম—ঠিক যেন এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে গেছি!
এই বইটি যে সহজ পাঠ্য নয়, তা প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়তেই বুঝে ফেলেছি। তবুও অধ্যাপকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং তাঁর আন্তরিক আস্থার মর্যাদা রাখতে আমি কলম তুলে নিলাম। এই বই পড়তে গিয়ে আমি যেন অনেক অজানা জগতের মুখোমুখি হলাম। তার লেখা কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং মানবিক বোধ, সমাজচিন্তা, ইতিহাস, দর্শন আর নৈতিক মূল্যবোধের এক অনুপম গাঁথুনি। তিনি সংকটের কথা বলেছেন, কিন্তু সেই সংকট শুধু ব্যক্তির নয়—সমাজের, রাষ্ট্রের, সময়েরও। তাঁর লেখায় দেখা যায়, কিভাবে চেতনার বিকাশ থেমে গেলে সভ্যতাও পিছিয়ে পড়ে। তিনি যেসব বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তা সহজ নয়, তবে গভীর মনোযোগ দিলে পাঠক বুঝতে পারবেন যে তিনি আসলে এক ধরনের বিবেক জাগ্রত করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
এই বইটি শুধু পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য নয়—বরং পাঠককে ভাবতে শেখানোর জন্য লেখা হয়েছে। আমি যতটুকু বুঝেছি, তা দিয়েই লেখাটি সাজানোর চেষ্টা করেছি। হয়তো আমার ভাষায় তেমন মাধুর্য নেই, হয়তো বিশ্লেষণে ঘাটতি আছে, কিন্তু হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকেই এই লেখাটি দিলাম। আমি কৃতজ্ঞ অধ্যাপক জিতেন্দ্র বড়ুয়ার প্রতি, তিনি আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে তাঁর অসাধারণ চিন্তা-জগতের অংশীদার করেছেন। এই আস্থা আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। আমি এই গ্রন্থের বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি। অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার দীর্ঘ সাহিত্যপথে শুভেচ্ছা ও সম্মান জানাই— “যাঁর কলম কেবল কথা বলে না, অন্তরও জাগায়।”
লেখকঃ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক,
গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব-চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।

  • অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার চিন্তা-মননের আলোকধারা ও মানবিক বোধের পাঠ