ডিআইজি নুরে আলম মিনা বরখাস্ত: ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় নেতা রাউজানের
নুরু হত্যায় মিনা ও কেফায়েত উল্লাহ আসামি না হওয়ার প্রশ্নে উত্তাল জনমত”
চট্টগ্রামের রাউজানের সাহসী তরুণ ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল আলম নুরুকে ২০১৭ সালে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা আজও এই জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। পুরো হত্যাকাণ্ডটি ছিল এক পরিকল্পিত ও পৈশাচিক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফসল, যার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা (বর্তমানে বরখাস্তপ্রাপ্ত ডিআইজি), তৎকালীন রাউজান থানার অফিসার ইনচার্জ কেফায়েত উল্লাহ এবং সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। অথচ, এতো বছর পরও এই চিহ্নিত অপরাধীদের কাউকে মামলার চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ন্যায়বিচার এখানেই প্রথমবারের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে।নুরুকে চট্টগ্রাম শহরের বাসা থেকে তুলে আনা হয় এসআই শেখ জাবেদের নেতৃত্বে, আর সেই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ ছক কষা হয় নুরে আলম মিনার কার্যালয়ে। পুলিশ অফিসার হয়ে তিনি একজন নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে কীভাবে হত্যার নির্দেশ দিতে পারেন—এই প্রশ্ন বহুবার উঠলেও, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব, পদ এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে কেউ তা প্রকাশ্যে বলতে সাহস পাননি।
নুরুকে তুলে এনে রাউজানের নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে নেওয়া হয়। সেখানে রাতে চলে নির্মম নির্যাতন। এসআই শেখ জাবেদ ফজলে করিমের কিলার বাহিনীর সহায়তায় নুরুকে বিবস্ত্র করে মারধর করেন, মাথায় গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করেন। হত্যার পরে ওসি কেফায়েত উল্লাহ এবং এসপি নুরে আলম মিনার নির্দেশে এস আই শেখ জাবেদ ও ফজলে করিমের সন্তাসীরা হত্যাকরে কর্ণফুলী নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পুরো হত্যাকাণ্ডটি ছিল এমনই নৃশংস এবং সুপরিকল্পিত, যা বাংলা সাহিত্যের কোনো দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়। হত্যার পরপরই শুরু হয় ঘটনাকে ‘অপমৃত্যু’ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। প্রাথমিকভাবে এসআই কামাল একটি অপমৃত্যু মামলা করেন, যা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআই ইন্সপেক্টর বশিরকে। অথচ, বশির কোনো তদন্ত না করে, কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার না নিয়ে, ফাইনাল রিপোর্টে উল্লেখ করেন—“স্বাক্ষী পাওয়া যায়নি”। তার দেওয়া প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্তদের—ফজলে করিম, নুরে আলম মিনা ও কেফায়েত উল্লাহর—নাম একেবারেই বাদ দেওয়া হয়। এই তদন্তকে সাজানো নাটক বলা যায়, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত খুনিদের আড়াল করা।
নুরু হত্যার বিষয়ে আমি একাধিকবার লেখালেখি করেছি। তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে জানিয়েছি, কীভাবে মিনা চট্টগ্রামের এসপি থাকাকালীন সরাসরি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় অংশ নেন, কীভাবে তিনি পেশাদার পুলিশের আদর্শ ভেঙে রাজনৈতিক হীন স্বার্থে একটি জীবন কেড়ে নেন। এসব লেখার পরও কেউ তদন্তের রুট পরিবর্তন করেনি—কারণ একটাই, মিনা ছিলেন তখন ক্ষমতার সিংহাসনে বসা দলের ছত্রছায়ায়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, নুরুর পরিবার পুনরায় চকবাজার থানায় একটি সুনির্দিষ্ট হত্যা মামলা দায়ের করে। অনেক আশা ছিল, এবার প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—নতুন মামলাতেও ডিআইজি নুরে আলম মিনা এবং ওসি কেফায়েত উল্লাহকে বাদ দেওয়া হয়। বরং মামলায় এমন কিছু নাম জুড়ে দেওয়া হয়, যারা হয়তো ঘটনাটির ধারে কাছেও ছিল না। নুরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাবুলকেও অযথা আসামি করা হয়। এতে স্পষ্ট হয়, নতুন মামলাটিও যেন আরেকটি বিভ্রান্তির জালে বন্দি। এই অবস্থায় আজ, যখন পুলিশ সদরদপ্তরের বরাতে জানা যায় যে ডিআইজি নুরে আলম মিনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে—তখন আশার আলো যেমন জ্বলে উঠেছে, তেমনি একটি বড় প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে: বরখাস্তই কি যথেষ্ট? নাকি এটি শুধুই আইওয়াশ? একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকেন, তবে তার কি কেবল চাকরিচ্যুতিই যথেষ্ট শাস্তি?
বরখাস্তের পেছনে বাস্তবতা হচ্ছে, মিনা দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। সরকারের পরিবর্তনের পর তিনি আতঙ্কে গা ঢাকা দেন। এখন বরখাস্তের মাধ্যমে হয়তো প্রশাসন নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে ন্যায়ের অগ্রগতি খুবই সামান্য। জনগণের প্রশ্ন এখন একটাই—এই খুনের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারীকে বাদ দিয়ে কি বিচার সম্পূর্ণ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর যতদিন না রাষ্ট্র নিজে সামনে এসে দেয়, ততদিন আমরা বলবো—“এটা বিচার নয়, এটা বর্বরতা আড়ালের প্রতারণা।” নুরুর রক্তের দায় কেউ এড়াতে পারবে না। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু চাপা পড়লেও ইতিহাসে এই হত্যার দায় রয়ে যাবে। আমরা যারা কলম ধরে, তারা থামবো না। যতদিন না নুরে আলম মিনা, কেফায়েত উল্লাহ এবং ফজলে করিম চৌধুরীর মতো অপরাধীরা কাঠগড়ায় দাঁড়ায়, ততদিন এই কলম থামবে না।
ন্যায়বিচার চাই—এই বার্তা নিয়ে নতুন করে আন্দোলনের আহ্বান জানাই। নুরুর মতো আর কোনো তরুণ যেন এমন নির্মম পরিণতির শিকার না হয়, সেই নিশ্চয়তা চাই রাষ্ট্রের কাছে।