কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের জীবন নিজেই একটি মহাকাব্য। যাঁদের কর্ম ও চিন্তা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলো দেখায়। তেমনই একজন মানুষ, যাঁকে নিয়ে লিখতে বসলে কলম থেমে যেতে চায় না, হৃদয় অভিব্যক্তির ছাপ রেখে যায় প্রতিটি শব্দে—তিনি জামাল উদ্দিন। একজন ইতিহাসবীদ, একজন নির্ভীক সাংবাদিক, একজন ধ্রুপদী লেখক এবং সবচেয়ে বড় পরিচয়—একজন স্বপ্ন বুনিয়ে যাওয়া মানুষ, যিনি শুধু নিজে লেখেননি, গড়েছেন লেখক, জাগিয়েছেন ইতিহাসের ঘুমন্ত ধুলো। জামাল উদ্দিন—এ নামটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক সাদামাটা অথচ আভিজাত্যে পরিপূর্ণ মুখ, যিনি বিনয় ও কঠোর সত্যের অপূর্ব মিশ্রণ। যার ভাবনায় ছিল দেশ, কলমে ছিল দ্রোহ, এবং হৃদয়ে ছিল চট্টগ্রামের ইতিহাসকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। আমার যাত্রা শুরু ১৯৯৪ সালে, তাঁরই পাশে, তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক “চট্রল চিত্র”-এ নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। সেই সময়কার পাঠকদের কাছে এই ম্যাগাজিন ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা। শব্দে শব্দে সেখানে ফুটে উঠত ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চিত্রপট। সেসব দিনের কথা ভাবলে মনে হয়—আমরা ছিলাম এক সূর্যোদয়ের প্রত্যক্ষদর্শী, যেখানে জামাল ভাই ছিলেন আমাদের নাবিক। তিনি ছিলেন বলকা প্রকাশনের কর্ণধার, যার ছায়ায় অসংখ্য নতুন লেখক সাহস পেয়েছেন। আজও প্রতিবছর তাঁর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় নতুন বই, নতুন চিন্তা, নতুন আন্দোলনের অঙ্গীকার।
তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি—তাঁর গবেষণা। শতাধিক ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ তাঁর হাত ধরে এসেছে বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু শুধু সংখ্যা দিয়ে তাঁর মেধা ও পরিশ্রমকে বিচার করা যাবে না। প্রতিটি বই যেন একেকটি সত্ত্বা—তথ্যের গভীরতা, ভাষার সৌন্দর্য এবং চিন্তার শৃঙ্খলা সব মিলিয়ে এক অসাধারণ ঐতিহাসিক সম্পদ।
“দেয়াং”—এই এক শব্দেই বোঝা যায় তাঁর গবেষণার গভীরতা। ‘দেয়াং রাজার’ বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস খুঁজে পেতে গিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে মায়ানমার পর্যন্ত। সেখানে গুপ্তচর সন্দেহে তাঁকে কারারুদ্ধ হতে হয়। কতজন গবেষক পারেন এমন ঝুঁকি নিতে? অথচ তিনি থেমে থাকেননি। ফিরেই লিখে ফেলেছেন দেয়াং-এর অজানা ইতিহাস। যাঁর গবেষণা এমন দৃঢ়, তাঁর কলম তো অবশ্যই হবে নির্ভীক। তিনি কেবল একজন ইতিহাসবীদ ছিলেন না, ছিলেন এক কথাবীর। তাঁর লেখায় ছিল চিন্তার দীপ্তি, শব্দে ছিল স্পষ্টতা, এবং সত্য বলার সাহস। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁর একটি “খোলা চিঠি”—যেটি ছিল সরকারের কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির এক নির্মম খণ্ডচিত্র—আজও পাঠকদের মনে দাগ কেটে আছে। এটি ছিল শুধুমাত্র একটি লেখনী নয়, বরং গোটা দেশের নিঃশ্বাস আটকে থাকা সত্যের এক সম্মিলিত উচ্চারণ। বিশেষ করে আনোয়ারার এমপি ও ভুমিমন্ত্রী সাইফুর জামান জাবেদের দুর্নীতির ফিরিস্তি তিনি যেভাবে সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছিলেন, তা শুধু একজন সাংবাদিক নয়—একজন দায়বদ্ধ নাগরিকের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরকাল। জামাল উদ্দিন ছিলেন অনুসন্ধানের এক ধ্রুপদী পথিক। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যখন সব কিছু কেবল এক ক্লিকের দূরত্বে, তিনি তখন হেঁটে হেঁটে, সরেজমিনে ঘুরে, প্রবীণদের স্মৃতিচারণ শুনে, রেকর্ড খুঁজে এনে ইতিহাসের পাতা নির্মাণ করেছেন। তাঁর লেখা ৫০০ থেকে ৭০০ পৃষ্ঠার প্রতিটি বই শুধু তথ্যভাণ্ডার নয়—তা যেন সময়ের কণ্ঠস্বর। আমার লেখক জীবনের সূচনায় তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কালুরঘাট সেতুর ইতিহাস বা কালু মাঝির নামকরণের কাহিনি—তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমি লিখেছি, খুঁজেছি, শিখেছি। আজ আমার ৩০টি বই প্রকাশিত হয়েছে, আরও কিছু প্রকাশের অপেক্ষায়—এই পথ চলার পেছনে তাঁর যে আলোর মশাল, তা আজও জ্বলছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল নির্মাণে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে জামাল উদ্দিন অগ্রগণ্য। তাঁর লেখা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে রেফারেন্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত—এটাই তাঁর বিশাল অর্জন। ইতিহাস যদি সভ্যতার আয়না হয়, তবে জামাল উদ্দিন সেই আয়নার নির্মাতা। তিনি একজন সম্পাদক, গবেষক, লেখক তো ছিলেনই—তারচেয়েও বড় ছিলেন একজন আলোকদ্রষ্টা। তাঁর চোখে ছিল ইতিহাসের গভীর পাঠ, তাঁর কণ্ঠে ছিল নির্ভীকতার জোর, আর হৃদয়ে ছিল বাংলার প্রতি ভালোবাসা। জামাল উদ্দিন আজও লেখেন, আজও ছাপান, আজও গড়েন নতুন লেখক। তাঁর নিরহংকারী আচরণ, আন্তরিকতা, মানবিকতা তাঁকে করে তুলেছে একজন “মানুষ”—এই শব্দের প্রকৃত অর্থে। সেই-১৯৯৪ সালের কথা। আমি তখন সাপ্তাহিক “চট্রল চিত্র” ম্যাগাজিনে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সম্পাদক ছিলেন জামাল উদ্দিন ভাই—যিনি তখনও আমার কাছে একজন পরিণত সাংবাদিক, দক্ষ সংগঠক এবং নির্ভরযোগ্য অভিভাবকতুল্য মানুষ। একদিন তিনি আমাকে বললেন, “কালুরঘাট সেতু নির্মাণের ইতিহাস আর কালুরঘাট নামকরণের পেছনের কাহিনি নিয়ে তুমি একটা লেখা লেখো।” এই কথাটা শুনে আমি এক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিলাম। এত বড় একটি ঐতিহাসিক বিষয়—তাও আবার আমার হাতে! আমি বলেছিলাম, “ভাই, আমি পারব তো?” তিনি তখন কেবল মৃদু হেসে বলেছিলেন,
“তুমি পারবে। কারণ তুমিই পারো সময়কে খুঁজে নিতে, ইতিহাসকে জানতে, তাকে শব্দে রূপ দিতে। এই কাজ তোমাকেই করতে হবে।” তারপর থেকে শুরু হয় আমার প্রথম ইতিহাস-ভিত্তিক গবেষণাধর্মী লেখার যাত্রা। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করি পুরাতন কাগজপত্র, রেলওয়ে আর্কাইভ, স্থানীয় প্রবীণদের স্মৃতিচারণ। সেই গবেষণায় উঠে আসে চট্টগ্রামের বিখ্যাত কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাল (১৯৩০-১৯৩৪), ব্রিটিশ ভারতের রেল সংযোগের প্রয়োজন, এবং এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল ‘কালুরঘাট’ নামকরণের পেছনের কাহিনি। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, সেতু নির্মাণের সময় থেকেই হয়তো এ নাম এসেছে। কিন্তু অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি জানতে পারি, এই নাম এসেছে “কালু মাঝি” নামে এক নিরীহ কেয়াঘাটের মাঝির স্মৃতিকে ঘিরে। কর্ণফুলী নদীর ওপারে পারাপারের একমাত্র ভরসা ছিলেন এই কালু মাঝি। মানুষ যাতায়াত করত তাঁর নৌকায়। সময়ের আবর্তনে তাঁর নামই জায়গার নাম হয়ে যায়—‘কালুরঘাট’। এই গল্প যেন চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক অনালোকিত অধ্যায়, যা মানুষের মুখে মুখে থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল—সেটি আমি তুলে আনতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র জামাল ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। এই একটি লেখা আমাকে ইতিহাসের প্রতি এক অমোঘ টান এনে দেয়। মনে হল, ইতিহাস যেন আমার হাত ধরে হাঁটতে চাইছে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। একের পর এক গবেষণামূলক লেখা, বই, প্রবন্ধ লিখেছি। আজ আমার লেখা গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশ ছাড়িয়েছে, আরও কিছু প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু সেই প্রথম লেখাটি, সেই প্রথম দায়িত্ব, সেই প্রথম উৎসাহ—সবই ছিল জামাল উদ্দিন ভাইয়ের দেওয়া। তিনি আমাকে শুধু লিখতে বলেননি, আমার ভিতরে থাকা ইতিহাসচর্চার অঙ্কুরটিকে জাগিয়ে তুলেছেন, লালন করেছেন, বিশ্বাস রেখেছেন। জামাল উদ্দিন ভাই শুধু একজন সম্পাদক বা গবেষক নন, তিনি আমার পথপ্রদর্শক, আমার বুদ্ধিদীপ্ত অভিভাবক, যিনি আমাকে কেবল সাংবাদিক বা লেখক বানাননি—একজন ইতিহাসসচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাঁর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁর দেওয়া সেই প্রথম সুযোগটাই আজ আমাকে ইতিহাসের পথযাত্রী করে তুলেছে। তাঁর মতো একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসা—এটা ছিল আমার জীবনের এক বড় আশীর্বাদ। আমার এই লেখা তাঁর বিস্ময়কর জীবন ও কর্মের শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র রূপায়ণ। তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে বহু পৃষ্ঠা, বহু খণ্ড গ্রন্থও যথেষ্ট নয়। কারণ তিনি কেবল একজন ব্যক্তি নন—তিনি একটি সময়, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস।