এক স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার গল্প

লেখক: মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ২ দিন আগে

যে নারী জীবন দিল, সেই নারীই অপমানিত: এক স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার নির্মম গল্প”

রক্তের সম্পর্ক নয়, ভালোবাসার আত্মত্যাগেই গড়ে ওঠে অনেক পবিত্র সম্পর্ক। কিন্তু যখন সেই আত্মত্যাগ পায়ে দলে কেউ ধোঁকাবাজি করে, তখন সে আর মানুষ নয়—সে হয় আত্মার খুনে, বিশ্বাসের ঘাতক। এই গল্প এক নারীর—উম্মে সাহেদীনা টুনির। যিনি ভালোবেসেছিলেন, স্বামীকে আগলে রেখেছিলেন, নিজের শরীর থেকে কিডনি দিয়েছিলেন—শুধু তারেক নামের এক পুরুষকে বাঁচাতে। কিন্তু জীবনদান পাওয়া সেই মানুষটাই পরিণত হয় এক রাক্ষসে। এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি গা শিউরে ওঠার মতো।
২০০৬ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় টুনি ও তারেকের। তারেক ছিলেন মালয়েশিয়া প্রবাসী। টুনি ছিলেন কলেজপড়ুয়া এক স্বপ্নময়ী তরুণী। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই তাদের কোলজুড়ে আসে পুত্রসন্তান—আজমাইন দিব্য। নবজাতকের কোমল হাসিতে স্বপ্ন বুনেছিলেন তারা, নতুন জীবনের।
কিন্তু খুব বেশি দিন টেকেনি সে সুখ। হঠাৎ করেই জানা গেল, তারেকের দুটি কিডনিই প্রায় অচল। এই সময়টায় অন্য কেউ হলে হয়তো ভেঙে পড়ত। কিন্তু টুনি লড়লেন। ছুটলেন দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত নিজেই দেন নিজের একটি কিডনি—স্বামীকে জীবনে ফিরিয়ে আনেন।
এমন আত্মত্যাগের পর একজন মানুষ কী করতে পারে? সারা জীবন ভালোবাসায় সিক্ত রাখতে পারে সেই নারীর জীবন। কিন্তু তারেক করলেন উল্টো। সুস্থ হতেই আসক্ত হলেন অনলাইন জুয়ায়, জড়ালেন পরকীয়ায়। আর যিনি জীবন দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনলেন, সেই টুনিকেই শুরু করলেন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। স্বামী যখন টাকাহীন, তখন স্ত্রীর রোজগারই ছিল সংসারের একমাত্র অবলম্বন। অথচ সে রোজগার নিয়েও তার ছিল অসন্তোষ। শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা আনতে চাপ দিতেন। আর যেই না মুখ খুলেছেন টুনি, শুরু হতো অশ্রাব্য গালিগালাজ, কখনো গায়ে হাত তোলা।
সবচেয়ে লজ্জার, সবচেয়ে ঘৃণার মুহূর্ত ছিল অপারেশনের পরে হাসপাতালের কেবিনে। সাতদিন আইসিইউতে থেকে কেবিনে উঠে আসা টুনি তখন দুর্বল, ক্লান্ত, রক্তশূন্য। আর তারেক? চিৎকার করে গালি দিচ্ছেন, কারণ অপারেশনের সময় তার এক আত্মীয় টাকা পাঠাতে দেরি করেছেন! এ দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসকরাও। অপারেশন করা চিকিৎসক নিজেই বলেছিলেন তারেককে— “তোমার মা যদি জন্মদাতা হন, তবে এই নারী তোমার জীবনদাতা। তার প্রতি এমন আচরণ তুমি কীভাবে করতে পারো?” কিন্তু মানুষের রক্তে যখন নষ্ট চরিত্র ঢুকে পড়ে, তখন এমন কথাও তার গায়ে লাগে না। দেশে ফিরে আরও নেমে যান নিচে। একপর্যায়ে চায় টুনির নামে থাকা বাড়িটিও লিখে দিতে। পরকীয়ার আসক্তিতে ভেসে যেতে থাকেন এক ডিভোর্সি নারীর প্রেমে, যার নাম তাহমিনা।
যেদিন স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে থানায় অভিযোগ করেন টুনি, সেদিনও মনে হয়েছিল, হয়তো সুবিচার পাবেন। কিন্তু কৌশলী তারেক একদিনের মাথায় মুচলেকা দিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অভিযোগ তুলিয়ে নেন। এরপর আরও নির্মম নির্যাতন শুরু।শেষমেশ টুনি প্রাণ বাঁচাতে বাবার বাড়ি পালিয়ে যান। এবং ২২ এপ্রিল আদালতে মামলা করেন নারী নির্যাতন ও যৌতুকের অভিযোগে।তারেক গ্রেপ্তার হন, এক মাস কারাগারে থাকেন। কিন্তু জামিনে বেরিয়েই ফিরে যান সেই তাহমিনার বাসায়। আবারও শুরু করেন টুনিকে হুমকি—ডিভোর্স চাই, বাড়ি লিখে দাও! এখন আত্মগোপনে তিনি। ফোন বন্ধ, আইনজীবী অনুপস্থিত, পরিবার নীরব।অন্যদিকে টুনি অসুস্থ শরীর নিয়ে লড়ছেন এক অসম লড়াই। শুধু একজন নারী হিসেবে নয়, একজন মা হিসেবে, একজন জীবনদাত্রী হিসেবে তার লড়াই এক ইতিহাস।এই গল্পটা আমাদের চারপাশের অনেক নারীর চেনা গল্প। শুধু কিডনি নয়, অনেক নারী দেন মনের কিডনি, স্বপ্নের হৃদয়, জীবনের সম্পূর্ণতা। আর প্রতিদানে পান ধোঁকা, অবহেলা, নির্যাতন।তারেক নামের সেই বিশ্বাসঘাতক আজ সমাজের মুখে এক থুথু। এমন পুরুষ শুধু স্বামী নয়, সে বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান, অকৃতজ্ঞ আত্মঘাতী দানব। টুনি নামের এই নারীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, তার সাহসিকতায় সম্মান। তার জীবন যেন আর কষ্ট না পায়, তার সন্তান যেন জানে—তার মা একজন যোদ্ধা, একজন বীর নারী। পাঠকের কাছে প্রশ্ন:
একজন নারী নিজের শরীর ছিঁড়ে কিডনি দান করল ভালোবাসায়। সেই নারীকেই কেউ প্রতারণা করে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, তাহলে তাকে মানুষ বলা যায় কি? আপনারা কী বলবেন? ই তারেকদের জন্য থুথু যথেষ্ট নয়—সমাজের ঘৃণা হোক তাদের একমাত্র প্রতিদান।

  • এক স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার গল্প