মব জাস্টিস- ন্যায়ের নামে অন্যায় এক নীরব হত্যাযজ্ঞ!

লেখক: মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ২ দিন আগে

সেদিন চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় একজন যুবককে রাস্তায় পেটাচ্ছিল জনতা। লোকজন বলল, “চোর ধরছি”, “শাস্তি দিতে হবে”। কেউ একজন মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছিল, আরেকজন লাইভে বলছিল, “এভাবে বিচার না করলে দেশ চলবে না।” ২০ মিনিট পরে পুলিশ এলে দেখা গেল ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন। সে শুধু দোকানে গিয়ে পানি চেয়েছিল। এই একটি দৃশ্যেই বোঝা যায়—বাংলাদেশে মব জাস্টিস বা গণপিটুনির সংস্কৃতি এখন কতটা অমানবিক ও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
‘মব জাস্টিস’ শব্দের ব্যাখ্যা ‘Mob Justice’ শব্দটির বাংলা অর্থ—গণআক্রমণের মাধ্যমে অপরাধের শাস্তি প্রয়োগ, যেখানে উত্তেজিত জনতা নিজেরাই “বিচারক” ও “শাস্তিকারী” হয়ে ওঠে। এটি বিচারহীন, নিয়ন্ত্রণহীন এবং প্রায়ই নিরীহ বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়। এতে বিচারব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, আইন—সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে দেয় এক ক্ষুব্ধ, আবেগে ভরপুর জনতা। সমাজে মব জাস্টিস বাড়ার কারণসমূহ
১. বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি ও অবিশ্বাস
দেশে মামলা নিষ্পত্তিতে বছর পেরিয়ে দশক কেটে যায়। অনেকে আদালতের দ্বারস্থ হয়েও ন্যায়বিচার পান না। এই হতাশা থেকে সাধারণ মানুষ নিজেরাই “তাৎক্ষণিক বিচারক” হতে চায়।
২. আইনের শাসন দুর্বল হওয়া
অনেক অপরাধী রাজনৈতিক আশ্রয়ে মুক্তি পেয়ে যায়। ফলে জনগণ মনে করে, আইনের চেয়ে নিজেরাই ভালো বিচার করতে পারবে।
৩. গুজব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “ছেলেধরা”, “ধর্ষক”, “চোর”, এমনকি “জঙ্গি” বলে গুজব ছড়িয়ে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
৪. জনসচেতনতার অভাব
আইন-আদালতের ধারণা অনেকের নেই। মানবাধিকার, তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, আত্মপক্ষ সমর্থন—এসব শব্দ এখনো সমাজে অপরিচিত অনেকের কাছে।
বাস্তব কিছু করুণ উদাহরণ
◉ তাসলিমা বেগম হত্যা (২০১৯)
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছেলেধরা সন্দেহে গৃহবধূ তাসলিমাকে স্কুলের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলে জনতা। তিনি আসলে তাঁর সন্তানকে নিতে গিয়েছিলেন।
◉ সিরাজগঞ্জে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের মৃত্যু (২০২২)
একজন মানসিক রোগীকে চোর ভেবে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মারা হয়। স্থানীয় কেউ পুলিশে খবর দেয়নি।
◉ খুলনায় চোর সন্দেহে বৃদ্ধের মৃত্যু (২০২3)
একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুক, বাজারে কিছু ফল নিতেই লোকজন ধরে নিয়ে মারধর করে। পরে জানা যায় তিনি ক্ষুধার্ত ছিলেন।
এই ঘটনারা শুধু বিচারের ভুল উদাহরণ নয়, সমাজের বিবেকের অপমৃত্যু।
সংবিধান ও আইন কি বলে?
বাংলাদেশ সংবিধানের
* ৩১ অনুচ্ছেদ: প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী
* ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ: কাউকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে শাস্তি দেওয়া যাবে না
* ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে ব্যক্তিকে আঘাত করা, হত্যার চেষ্টা, অপহরণ ইত্যাদির জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে
সুতরাং, মব জাস্টিস সরাসরি সংবিধান ও ফৌজদারি আইনের পরিপন্থী, এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মানবিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ
আমরা যদি প্রতিটি মানুষকে সন্দেহ করেই শাস্তি দিই, তাহলে সভ্যতা বলে কিছু থাকবে না। বিচার না জেনে কাউকে মারা—এটা পশুত্ব, তা ধর্মেও নিষিদ্ধ।
ইসলাম, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম—সব ধর্মই অন্যায়ের বিরুদ্ধে হলেও, ন্যায়বিচার ছাড়া শাস্তির বিরোধিতা করে।
একজন মানুষ অপরাধী হলেও, তার প্রমাণ দরকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দরকার। সেটিই মানবতা।
করণীয়: সমাধানের পথ কী?
১. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: পুলিশ ও বিচার বিভাগকে আরও দক্ষ ও দ্রুতগতিসম্পন্ন করতে হবে
২. জনসচেতনতা গড়ে তোলা: টিভি, পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে
৩. গুজব দমন: গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে
৪. কমিউনিটি পুলিশিং: স্থানীয়ভাবে পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়াতে হবে
৫. শিক্ষার প্রসার: নৈতিকতা, আইনজ্ঞান ও মানবাধিকারের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে থাকতে হবে,মব জাস্টিস কোনো সমাধান নয়, এটি বরং সমাজের আইনবিহীনতার প্রতীক। এ প্রবণতা আমাদের মানবিকতা, সামাজিক সংহতি এবং আইনবোধকে ধ্বংস করে দেয়।
আমরা যদি সত্যিকারের ন্যায়বিচার চাই, তবে সে পথে হাঁটতে হবে আইন, যুক্তি ও মানবতার আলোকে—not উত্তেজিত জনতার মুষ্টিতে।
তাই আজ প্রয়োজন—মব জাস্টিস নয়, ন্যায়বিচার হোক রাষ্ট্রের ভিত্তি।

  • মব জাস্টিস- ন্যায়ের নামে অন্যায় এক নীরব হত্যাযজ্ঞ!